Duba Club

প্রীতি আর স্মৃতিতে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jun 09, 2025By Dr Sahid Ullah (lipon)

DS

[এই প্রবন্ধটি ডিইউ অ্যালামনাই চট্টগ্রামের 'শতবর্ষের আলোবর্তিকা’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত]

ডিইউ এলামনাই চিটাগং ম্যাগাজিন



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ছিল আমার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রত্বের কাল । কলাভবনের শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার এ বিদ্যায়তনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন কিংবা হাকিম চতুরের শিরিষ গাছের তলায় আড্ডা, আবাসিক হলের বন্ধুদের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনাকে শানিত করার দীক্ষাও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা অন্যদের মতো আমার জীবন ও মননের অবিস্মরণীয় স্মৃতি।

এলামনাই অফিসে সাম্প্রতিক ফল উৎসবের ছবি।


রাজনীতির সঙ্গে আমার যৎসামান্য যোগসূত্রে আগে থেকেই জানতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছে, সবক্ষেত্রে অগ্রণী থেকেছে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তা এবং জনকল্যাণের ব্রত। এছাড়া দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষাথীদের মিলন এবং জ্ঞান ও মনন চর্চায় বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হবার বাসনা থেকেই আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতি টান ছিল । আর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির বিষয়টি কাকতালীয় বলা চলে । খ-ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম ৩০ জনের যে কোন বিভাগে ভর্তির সুযোগ থাকলেও ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম হত্যাকান্ড এবং ঐদিন ফটো সাংবাদিক শিশির বড়ুয়ার সঙ্গে একটি ঘটনা আমাকে সত্যিকারার্থে সাংবাদিকতা পড়তে উৎসাহিত করে। সে ঘটনার বিবরণ এক্ষণে দেয়ার সুযোগ নেই বলে অন্যত্র বলবো।

এলামনাই সদস্যরা ফল গ্রহণ করছেন।


ঢাকায় আমার মেজো চাচা শের-এ- বাংলা নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মাহবুবুল হক (মরহুম) এর তত্ত্বাবধানে ভর্তি পরীক্ষা এবং ছাত্র নেতা জাহাঙ্গীর চৌধুরী রতন (বেলজিয়াম প্রবাসী) এর সহায়তায় হলে ওঠা, তারপর ছাত্রনেতাদের সান্নিধ্য, ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, থিয়েটার স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হওয়া, স্বল্পদৈঘ্য চলচ্চিত্রের আন্দোলনে যুক্ত হওয়া, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে ক্ষুদ্র পরিসরে যুক্ত রাখা, পরে গণতান্ত্রিক পটপরিবর্তন দেখা, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে গঠিত গণআদালতের বিচারকাজের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়া, আমার ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোকে শানিত করা -সবকিছুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া আছে।

২০২৫ এর ইফতার মাহফিলের গ্রুপ ফটো।


স্বৈরাচার রিরোধী আন্দোলনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হল বন্ধ, কিংবা ছাত্ররাজনীতির অন্ত:কলহে অনেকের (এস এম হলের মেধাবী ছাত্র আরিফ ভাই, জাহিদ, চুন্নু, মনিরুজ্জামান বাদল, রাজু, পাগলা শহীদ) মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, হলের রুম জ্বালিয়ে দেয়া এবং শেষতক নিরাপত্তার অভাবে হল ছেড়ে দেয়ার দু:সহ স্মৃতি যেমন প্রোজ্জ্বল, তেমনি অসাধারণ মেধাবী ও প্রাজ্ঞ শিক্ষকদের সান্নিধ্য প্রাপ্তিতেও আমার সুখ। এতো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জ্ঞান-বিদ্যা, মানবিক মানুষ হওয়ার দীক্ষাও আমার মতো সকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

মিডিয়া কভারেজ।


আজ একশো বছর পাড়ি দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আমার সেই স্বপ্নগুলো কেমন করে যেন ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে। কী গবেষণায়, কী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে, কী সুন্দর সমাজ গঠনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় আর তেমন অবদান রাখতে পারছেনা বলেই মনে হয়। প্রতিনিয়ত শিক্ষার পরিবর্তে চাকুরীর জন্য পড়ছে, মানবিক মানুষের পরিবর্তে শুধুমাত্র ক্যরিয়ার ভিত্তিক চিন্তার প্রসারে শিক্ষার্থীরা নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখছে। পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই হাজার শিক্ষকের মধ্যে (হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া) বাকিরা জ্ঞান চর্চা, গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখা কিংবা জ্ঞান গভীরতায় ক্রমেই বৈষয়িক হয়ে পড়ছেন। এমনকি টক-শোর মতো সস্তা বিনোদনের ক্রীড়ানক হিসেবেই নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হতে দেখছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গবেষণায় মাঝে মধ্যে কুম্ভিলবৃত্তির অভিযোগ দেখলে আমি বিব্রত হই।
শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষে শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভৌত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, ভৌত মহাপরিকল্পনার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। সুনাগরিক ও বিশ্বনাগরিক গড়ে তুলতে উচ্চশিক্ষায় যে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, তা সম্পন্ন করে
শিক্ষা-জ্ঞান-দক্ষতা ও গবেষণার একাডেমিক মহাপরিকল্পনা তৈরি করা দরকার; নইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির মান ক্রমেই নিচের দিকে যাবে। একারনেই বোধকরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন, প্রত্যাশা এবং আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই।

শতবছর আগে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলার অবহেলিত জনপদে একটি শিক্ষিত-বুদ্ধিদীপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির বিবর্তন ও উন্নয়নে যদি কোনো একক প্রতিষ্ঠান অব্যাহতভাবে অনন্য সাধারণ অবদান রেখে থাকে, সেটি নিঃসন্দেহে আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যিকারার্থে বলতে গেলে বলা চলে ১৯২১ থেকে ২০২১- এই ১০০ বছর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ। বি সবার মতো আমার প্রশ্ন জাগে আগামী ১০০ বছরও কী দেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ হবে? আজকে দেশে ৫৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সঙ্গে আছে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন, গবেষণা করছেন, উচ্চ শিক্ষায় নিজেদের অবদান রাখছেন; প্রতিযোগিতায় তারাও পিছিয়ে নেই। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তাধারা পাল্টাতে হবে। পুরোনো চিন্তাধারা হয়তো বিগত ১০০ বছরের জন্য ঠিক ছিল, বর্তমান ও আগামীর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ বলা নইলে কঠিন হবে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বা আমাদের সকলের জন্য মাতৃসম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমরা অনেকভাবে ঋণী। সেই ঋণ পরিশোধ করা অসম্ভব। কোনো ঋণ আছে যেগুলো পরিশোধ না করা ভালো এবং সেই ঋণগুলো যত বাড়ে ততই মঙ্গল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার বা আমাদের ঋণও সেই রকমের। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে এবং আমাদের অনেককে বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা শিখিয়েছে, নেতিবাচক দিকগুলোকে ইতিবাচক বিষয়ে রুপান্তরের কৌশল শিখিয়েছে। আমার যা কিছু গর্বের, অর্জনের সবকিছুর অগ্রভাগে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমি ভাগ্যবান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল । বন্ধু জুটেছিলো, জীবনের সোনালী যুগ কেটেছিল কলা ভবন, কার্জন হল, মল চত্বর, টিএসসি, সলিমুল্লাহ হলের মায়াবী চত্বরে সেই তিন দশক আগে। আজ নতুন প্রজন্মের কিছু তরুন প্রাক্তণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে- যাদের উদ্যোম আছে, দেশকে ভালোবাসার একাগ্রতা আছে; আছে অফুরান স্বপ্ন; তাদের মিলন মেলায় সঙ্গী আমিও।

-ড. মোহাম্মদ সহিদ উল্যাহ (লিপন)
অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়